ড. খোন্দকার মেহেদী আকরাম:
গত সপ্তাহে বাংলাদেশ রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (বিআরআইসিএম) একটি ন্যাজাল স্প্রে উদ্ভাবনের দাবি করেছে। যার নাম রাখা হয়েছে ‘বঙ্গোসেফ ওরো নেজাল স্প্রে’। তাদের দাবি, পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম এ ধরনের স্প্রে উদ্ভাবন করেছে।
তারা দাবী করেছে তাদের উদ্ভাবিত নেজাল স্প্রে কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের নাকে এবং মুখগহ্বরের ৩/৪ ঘন্টা পরপর ব্যাবহার করলে তা নাক এবং মুখগহ্বরের থাকা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করে। এতে করে কোভিড রোগীদের ভাইরাল লোড কমে যায় এবং সংক্রমণ বিস্তার রোধে সহয়তা করে। তাদের দাবি এই স্প্রে ব্যবহার করলে কেউ যদি করোনা আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসে তাহলে তার করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি কমে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেছে যে তারা ঢাকা মেডিকেলের ২০০ জন কোভিড-১৯ রোগীর উপর তাদের ন্যাজাল স্প্রেটির ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে এই ফলাফল পেয়েছে। তবে তাদের ন্যাজাল স্প্রেতে কী উপাদান রয়েছে এবং তা কিভাবে কাজ করে তা কিছু উল্লেখ করেনি।
ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ডট গভ ওয়েব সাইটের নিবন্ধন তথ্য থেকে দেখা যায় যে বঙ্গোসেফ ওরো ন্যাজাল স্প্রেতে কার্যকরী উপাদান হিসেবে তারা ব্যবহার করেছে ০.৪%, ০.৫% এবং ০.৬% শক্তির পোভিডন আয়োডিন সলিউশন। ওপেন লেবেল ফেইজ-২ প্ল্যাসিবো কন্ট্রোল্ড রেন্ডোমাইজড ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালটি করা হয়েছে ২০০ জন কোভিড-১৯ রোগীর উপর। ট্রায়ালটি শুরু হয়েছে জুলাই মাসে। এই ট্রায়ালে নাকে এবং মুখগহ্বরের পোভিডন আয়োডিন স্প্রে করার পর সোয়াব নিয়ে আরটি-পিসিআর করে দেখা হয়েছে যে এই স্প্রে করোনাভাইরাস ধ্বংস করে কিনা।
পোভিডন আয়োডিন একটি বহুল ব্যবহৃত এন্টিসেপ্টিক কেমিক্যাল যা ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস সহ সকল জীবানু ধ্বংসে বেশ কার্যকরী। অপারেশনের সময় ত্বক এবং ক্ষত স্থানের জীবানু ধ্বংসে ১০% পোভিডন আয়োডিন সলিউশন ব্যবহৃত হচ্ছে নিয়মিত। হ্যান্ডওয়াশে ব্যবহৃত হয় ৭.৫% সলিউশন। মাউথওয়াশ এবং ন্যাজাল স্প্রেতে পোভিডন আয়োডিন ব্যবহৃত হয় যথাক্রমে ১% এবং ০.০৮%।
সাম্প্রতিক বেশ কয়েকটি ইন-ভিট্রো ল্যাবরেটরী গবেষণায় দেখা গেছে ০.৫% পোভিডন আয়োডিন ৩০ সেকেন্ডের ভেতরেই করোনাভাইরাস ধ্বংস করতে সক্ষম। ইন্ডিয়ার সাম্প্রতিক একটি গবেষণায় দেখা যায় যে ০.৫% পোভিডন আয়োডিন ন্যাজাল ড্রপ সহনশীল এবং নিরাপদ। পূর্ববর্তী গবেষণা থেকে জানা যায় যে স্বল্প মাত্রার (০.১-০.৫%) পোভিডন আয়োডিন নাকের ঝিল্লি এবং ঘ্রাণশক্তিতে তেমন কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।
এসব পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের উপর ভিত্তি করেই করোনা প্রতিরোধে পোভিডন আয়োডিনের রিপারপাসিং ব্যবহারের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কোভিড-১৯ শে এই ন্যাজাল স্প্রের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশে।
বাংলাদেশের ফেইজ-২ ক্লিনিক্যালটি সম্পন্ন হয়েছে যার ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি। হয়তো অচীরেই এই ট্রায়ালের ফলাফল প্রকাশিত হবে। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের ট্রায়ালের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলো। তবে কোভিডে এর বিস্তৃত ব্যবহারের আগে বড় পরিসরে ফেইজ-৩ RCT ট্রায়াল করাতে হবে।
কোভিডে বঙ্গোসেফ ওরো ন্যাজাল স্প্রের ব্যবহারে কয়েকটি সতর্কতা:
(১) এই ওরো ন্যাজাল স্প্রে শুধু মাত্র নাসারন্ধ্র এবং মুখগহ্বরের থাকা করোনাভাইরাসকে ধ্বংস করতে সক্ষম। যা ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারে অন্তরায় হিসেবে কাজ করতে পারে।
(২) তবে এখন পর্যন্ত এমন কোন এভিডেন্স বা প্রমাণ নেই যে পোভিডন আয়োডিন ন্যাজাল স্প্রে করোনা সংক্রমণ রোধ করতে পারে। অতএব, করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র কার্যকরী পন্থা হচ্ছে মাস্ক পরিধান করা যা ৮৫ শতাংশ সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
(৩) ধারণা করা হয় মাস্কের সাথে পোভিডন আয়োডিন ন্যাজাল স্প্রে ব্যবহার করলে সুরক্ষার ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি সুবিধা পাওয়া যেতে পারে।
(৪) তবে মাস্ক না পরে শুধু পোভিডন আয়োডিন ন্যাজাল স্প্রে ব্যবহার করলে করোনা সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই। কারণ করোনাভাইরাস নাসারন্ধ্র বা মুখগহ্বরের দেয়াল বেয়েবেয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে না। ভাইরাসটি নিঃশ্বাসের সাথে সরাসরি ফুসফুসে চলে যায় এবং সেখানেই মূল অসুখটি সৃষ্টি করে। আমাদের নিঃশ্বাসের সাথে করোনাভাইরাস ঘন্টায় ৯ কিঃ মিঃ গতিতে ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং ঠিক কখন তা প্রবেশ করছে তা বোঝার কোন উপায় নেই। আর এ কারনেই ন্যাজাল স্প্রে বায়ুর সাথে চলমান এই ভাইরাসকে ধ্বংস করতে পারে না। এই স্প্রে শুঘু ধ্বংস করে নাসারন্ধ্রে বা ত্বকে লেগে থাকা ভাইরাসকে।
লেখক: এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।